ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস: উত্তর -পূর্ব ভারত অশান্ত

ভারতে বিরোধীদলগুলোর প্রবল বিরোধিতা এবং উত্তর -পূর্ব ভারতে ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে পাশ হলো সিটিজেন এমেন্ডমেন্ট বা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। বিল পাশের প্রতিবাদে অশান্ত হয়ে উঠেছে উত্তর -পূর্ব ভারত। কোন কোন জায়গায় কারফিউ দেয়া হয়েছে, মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী।

Students protest against the Citizenship Amendment Bill in Guwahati, Assam, India

Students protest against the Citizenship Amendment Bill in Guwahati, Assam, India Source: AAP

ভারতে মধ্যরাত পর্যন্ত চলা লোকসভার অধিবেশনের পর রাজ্যসভায় দীর্ঘ বিতর্কের পর সাম্প্রতিক সবচেয়ে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি পাশ হয়ে গিয়েছে। আর লোকসভায় ৩১১-৮০ ভোটে হেরে গেলেও, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে বিরোধীরা তা আটকে দেওয়ার জন্যে চেষ্টা চালিয়েছিল রাজ্যসভায়, কিন্তু সেখানেও হেরে গেছে ১২৫-৯৯ ভোটে।

কংগ্রেস ,তৃণমূল কংগ্রেস ,ডি এম কে ,এন সি পি ,সি পি এম ,সি পি আই ,মুসলিম লীগ ,এম আই এম এবং তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বিলটি আটকানোর জন্যে এক হয়েছিল। এখন শুধু রাষ্ট্রপতির নিয়মমাফিক বিলে সই করা বাকি। আর বিল পাশ হয়ে যাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ  বলছেন, কোন ভাবেই মুসলিম মুক্ত হবে না ভারত। 

আসলে, এই সংশোধনী গৃহীত হওয়ার পর ভারতের প্রতিবেশী তিন দেশের অ -মুসলিম সংখ্যালঘু শরণার্থীরা দেশের নাগরিকত্ব পাবেন দাবি করছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আর বিরোধীদের অভিযোগ ,ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের এই প্রস্তাব দেশের সাত দশকের পুরোনো স্বীকৃত সংবিধানের নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, খুব দ্রুত গোটা দেশে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এন আর সি কার্যকর করা হবে। আর এরপরই,পক্ষে -বিপক্ষের বিতর্ক -বক্তব্য -বিক্ষোভে উত্তাল ভারত। বিরোধীরা সংসদের ভিতরে -বাইরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, উত্তর পূর্বের মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। 

অবস্থা এমন যে অসম এবং ত্রিপুরায় বহু জায়গায় কারফিউ জারি করা হয়েছে বা ১৮৮ ধারা। বন্ধ রাখা হয়েছে ইন্টারনেট পরিসেবা, অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে উড়িয়ে আনা হচ্ছে সেনা বাহিনীও। গুয়াহাটি বা রাজধানী দিসপুরে হাজারো ছাত্র যুব যেভাবে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাতে অনেকের আশির দশকে, আসসুর নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলনের স্মৃতি ফিরে আসছে। গুয়াহাটিতে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল, তা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। ত্রিপুরাতেও একই অবস্থা। সেখানে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন অ -জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষজন।  অবস্থা সামাল দিতে পুলিশকে গুলিও চালাতে হয়েছে। 

কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন, উত্তর -পূর্ব ভারতকে জনজাতি শূন্য করার চক্রান্ত চালাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ। উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, অসমবাসীদের ভাষাগত এবং সাংবিধানিক সব ধরণের অধিকার সুরক্ষিত রাখা হবে। অসম চুক্তির ষষ্ঠ ধারা রূপায়ণ করা হবে। এই বিলে মোটেও অসম বা উত্তর -পূর্বের ভূমিপুত্রদের স্বার্থহানি করা হবে না।  

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিরোধীদের সব অভিযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাঁর যুক্তি, ১৯৫০ সালের নেহেরু -লিয়াকত চুক্তি যদি সফল ভাবে বাস্তবায়িত হত, তাহলে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি আনার প্রয়োজন হত না। গোটা বিলের পিছনে কংগ্রেসের একসময়ের রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন তিনি। একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, বিল পাশ হলে ভারতে বসবাসকারি মুসলিমদের ভয়ের কিছু নেই। এই দেশের মুসলিমদের সঙ্গে কোন ভেদাভেদ করা হবে না। একই সঙ্গে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, ভারতের উত্তর -পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই।

রাজ্যসভায় অমিত শাহের কিছু মন্তব্য নিয়ে অবশ্য বিতর্ক হচ্ছে। বিরোধীদের অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, গোটা পৃথিবী থেকে যদি মুসলিমরা এসে এ দেশের নাগরিকত্ব চান, তাহলে তা দেওয়া সম্ভব নয়। এভাবে চলতে পারে না। একইভাবে, এই বিল কোনভাবেই মুসলিম বিরোধী নয় তাও বলেছেন তিনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কোথায়, প্রতিবেশী তিন দেশের রাষ্ট্রধর্ম হল, ইসলাম। সেই কারণেই শরণার্থী হিসাবে আসা তিন দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। না হলে, উৎপীড়নের শিকার ওই মানুষেরা কোথায় যাবেন ?

সংসদের উভয় কক্ষে বিল পাসের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন,সমবেদনা এবং সৌভার্তৃত্বের যে সংস্কৃতি আমাদের রয়েছে, এই বিলটি তার মাইল ফলক।

কিন্তু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য মানতে নারাজ, উত্তর -পূর্বের বহু মানুষ। বিক্ষোভে উত্তাল অসম সহ বেশ কয়েকটা রাজ্য। গুয়াহাটিতে বিক্ষোভের জেরে পুলিশকে লাঠি চালাতে হয়েছে। যানবাহনে আগুন লাগানো হয়েছে। অবস্থা এমন একসময়, মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনেবল কে বিমানবন্দরে আটকে পড়তে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা বিঘ্নিত হয়েছে, ট্রেন লাইনে অবরোধ হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট উত্তপ্ত। 

এখন ঘটনা হলো, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়ণের শিকার অমুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে  নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে। তা নিয়ে শুরু থেকেই প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে উত্তর -পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো। তাঁদের দাবি, প্রতিবেশী দেশ থেকে দলে দলে অমুসলিমরা এসে ভিড় জমালে, তাদের জীবন যাত্রায় প্রভাব পড়বে। বদলে যাবে, আর্থ -সামাজিক প্রেক্ষাপট। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে, তাঁদের শতাব্দী প্রাচীন সংস্কৃতি। 

আর এখানেই আবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশন বা, ইউএসসিআইআরএফ। বলা হচ্ছে, এই বিলে ধর্মীয় মানদণ্ড বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যা অত্যন্ত বিপদজনক। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, বহুত্ববাদী ইতিহাস এবং দেশের সংবিধান, যা ধর্ম -বর্ণ  নির্বিশেষে সবার সমানাধিকারের কথা বলে, এই বিল  তার পরিপন্থী। এর ফলে, ভারতের কয়েক কোটি মুসলিমের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে আমেরিকার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশন। স্বভাবতই এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ভারত।  বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র রবিষকুমার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ইউ এস সি আই আর এফ-র এই দাবি পুরোপুরি ভুল। পক্ষপাতদুষ্ট মন্তব্য করা হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনেই এমনটা বলা আছে। এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপের কোন অধিকার নেই, আমেরিকার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশনের।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা এনআরসি, একই কয়েনের এপিঠ -ওপিঠ। দেশের নাগরিক সবাই, সবাই ভোট দেন, সবার পরিচয়পত্র রয়েছে। ভোটার কার্ড থেকে রেশন কার্ড, স্কুল সার্টিফিকেট, জমির বা বাড়ির দলিল বা পাট্টা। কিছু না কিছু রয়েছে। এর পরেও, স্বাধীনতার সাত দশক সময় পরে আবার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কেন ?

আর বাস্তব হল, বিল পাশের পর আরও মসৃন হল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসা অ-মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ। ২০১৪-র ৩১ ডিসেম্বর বা তার আগে থেকে ভারতে শরণার্থী হিসাবে বাস করলে নাগরিকত্বের আবেদন জানাতে পারবেন।
   


Share
Published 12 December 2019 5:41pm
By Partha Mukhapadhdhaya
Presented by Shahan Alam

Share this with family and friends


Follow SBS Bangla

Download our apps
SBS Audio
SBS On Demand

Listen to our podcasts
Independent news and stories connecting you to life in Australia and Bangla-speaking Australians.
Ease into the English language and Australian culture. We make learning English convenient, fun and practical.
Get the latest with our exclusive in-language podcasts on your favourite podcast apps.

Watch on SBS
SBS Bangla News

SBS Bangla News

Watch it onDemand