অস্ট্রেলিয়ান পরিবারের বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেয়া ওয়াজিউল্লাহ এখন তাসমানিয়ার নামী শেফ

Waji Ullah

ওয়াজি স্পাইবি Source: ওয়াজিউল্লাহ

ওয়াজিউল্লাহকে সাত বছর বয়সে বাংলাদেশের এক এতিমখানা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আনা হয়। তিনিই সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যাকে কোনো অস্ট্রেলিয়ান পরিবার বাংলাদেশ থেকে দত্তক নিয়েছিল। বাংলাদেশের ভোলার চরফ্যাশনে ‘দোজ হু হ্যাভ লেস’ নামের এতিমখানায় ছিলেন ওয়াজিউল্লা। তার শৈশব, তারুণ্য আর অস্ট্রেলিয়ায় নতুন বাবা-মায়ের আদরে বেড়ে উঠার গল্প শোনালেন এসবিএস বাংলা-কে।



হাইলাইটস

  • ওয়াজি সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যাকে কোনো অস্ট্রেলিয়ান পরিবার বাংলাদেশ থেকে দত্তক নিয়েছিল
  • ওয়াজি গর্ব করে বলেন, তিনি বাঙালি এটা তার গর্ব, কখনই ভুলে নি তার জন্মভূমিকে
  • বাঙালি খাবারের স্বাদ ওয়াজির কাছে মনে হয় এটি সত্যিকারের খাবার

বাংলাদেশের ভোলার চরফ্যাশনে ‘দোজ হু হ্যাভ লেস’ নামের এতিমখানাটি চালু করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক অ্যালেন রিড। ভোলার সেই এতিমখানায় অস্ট্রেলিয়া থেকে এক বছরের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হয়ে গিয়েছিলেন লিন্ডা মেরো। অস্ট্রেলিয়ায় তাঁর বোন জোন স্পাইবি চেয়েছিলেন একটা ছেলে সন্তান দত্তক নিতে। লিন্ডা মেরো অ্যালেন রিডকে তার বোনের ইচ্ছার কথা জানান।

ওয়াজিউল্লাহর দরিদ্র মায়ের সঙ্গে কথা বলে তাকে দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করেন অ্যালেন। পরে লিন্ড মেরো নিজের সঙ্গে  করে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসেন ওয়াজিকে। শুরু হয় ওয়াজিউল্লার নতুন জীবন ওয়াজি স্পাইবি হয়ে। এরই মধ্যে কেটে গেছে কয়েক দশক। ওয়াজি স্পাইবি এখন তাসমানিয়ার একজন নামী শেফ। সময়ের সঙ্গে তাঁর ‘ফিউশন’ জনপ্রিয়তা পেয়েছে তাসমানিয়া জুড়ে।
ঝড় থামার পর চারপাশে তাকিয়ে দেখি কেউ যেন আয়না বিছিয়ে দিয়েছে, যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।
ওয়াজি স্পাইবি তার ফেলে আশা স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, ১৯৭০ সাল, সে বছর উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়। এতে প্রায় ৫০০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। মারা যান ওয়াজির বাবা শামসুল হক বেপারি। সে রাতের কথা এখনো ভুলে নি ওয়াজিউল্লাহ। ‘ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তার ভেসে যাওয়ার কথা স্পষ্ট মনে আছে। "ঝড় থামার পর চারপাশে তাকিয়ে দেখি কেউ যেন আয়না বিছিয়ে দিয়েছে, যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।”

প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর পিতৃহারা অসহায় দরিদ্র ওয়াজিউল্লাহকে তার এক চাচা রেখে আসেন চরফ্যাশনের সেই এতিমখানায়। সেখান থেকে পরবর্তীতে বদলে যায় তার জীবন। স্বেচ্ছাসেবক লিন্ডা মেরোর হাত ধরে অস্ট্রেলিয়া এসে পায় নতুন বাবা-মা জ্যাক স্পাইবি ও জোন স্পাইবি। নতুন মা–বাবার আদরেই শুরু হয় ওয়াজিউল্লাহর জীবন, হয়ে যান ওয়াজি স্পাইবি।
স্পাইবি পরিবার সম্পর্কে ওয়াজি বলেন, তারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে অনেক আদর দিয়েই বড় করেছেন।
ওয়াজির বয়স তখন ৭ বছর। নতুন মা-বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের ছোট শহর ফ্রস্টারের এক নতুন মানুষ তিনি। নতুন মা-বাবার আদরে-সোহাগে বড় হয়ে উঠতে থাকেন ওয়াজি স্পাইবি নামে। পড়াশোনা শুরু হয় সেখানকার স্কুলে। ইংরেজি ভাষাও রপ্ত করেন। এক বছরের মধ্যেই ভুলে যান বাংলা ভাষা।

স্পাইবি পরিবার সম্পর্কে ওয়াজি বলেন, আমি যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসি তখন আমার নতুন মায়ের একটি খামার ছিল আর বাবা ইস্পাত কারখানায় কাজ করতেন। তাঁরা ধনী ছিলেন না, তবে খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে অনেক আদর দিয়েই বড় করেছেন। একসময় পরিবারের সঙ্গে ওয়াজি স্পাইবি চলে যান তাসমানিয়ার হোবার্ট শহরে।

মেলবোর্নের উইলিয়াম আংলেস ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেন রন্ধনশিল্প নিয়ে। পেশা গড়েন শেফ হিসেবে। ওয়াজি প্রথমে এক ফরাসি রেস্তোরাঁয় কাজ দিয়ে শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন দেশের খাবার বানাতে শেখেন তিনি। পরবর্তীতে তৈরি করেন নিজস্ব রেসিপি এবং এ দিয়েই শুরু করেন ওয়াজি ফুড নামে নিজস্ব ক্যাটারিং ব্যবসা।

স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিজস্ব স্বাদ দিয়ে ফিউশন খাবার তৈরির দক্ষতা অর্জন করেন। সময়ের সঙ্গে তাঁর ‘ফিউশন’ জনপ্রিয়তা পায় তাসমানিয়া জুড়ে। তবে বাঙালি খাবারের স্বাদ তার কাছে মনে হয়েছে, এটি সত্যিকারের খাবার। খাবারের প্রতি ভালোবাসাই তাকে নিয়ে এসেছে এতদূর।
দেশে কাউকে চিনি না, কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই, সেখানে আমার মনে হয় না আমি কাউকে কোনো দিনই খুঁজে পাবো।
একদিনের জন্যও ওয়াজিউল্লাহ ভুলতে পারেন নি শৈশবের স্মৃতি। বাংলাদেশে মা, চার ভাই আর একমাত্র বোনকে দেখার ইচ্ছা বয়ে বেরিয়েছেন বছরের পর বছর। তারপর তিনি নিয়মিত অর্থ পাঠাতেন ওই এতিমখানায়। তার বিশ্বাস ছিল, এই এতিমখানার মাধ্যমে সেই অর্থ পৌঁছে যাবে তার পরিবারের কাছে।

অন্যদিকে, ওয়াজি ভাবেন ঠিকানাহীন পরিবারের সন্ধান করবেন কী করে। একসময় ভাবতেন যে, দেশে কাউকে চিনি না, কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই, সেখানে আমার মনে হয় না আমি কাউকে কোনো দিনই খুঁজে পাবো। আশা ছাড়েন নি, যোগাযোগ করেন ওই এতিমখানার সাথে। তারপর একদিন চলে যান বাংলাদেশে, খুজে পান মা ভাই ও বোনকে। এতিমখানার কর্তৃপক্ষই ওয়াজির পরিবারের সন্ধান দেয়, ব্যবস্থা করে সাক্ষাতের।
আমি বাংলা ভাষা ভুলে গেছি। তাই মনের ভাব বাংলায় প্রকাশ করতে পারি নি।
ওয়াজি বলেন, সে এক অন্য রকম মুহূর্ত। কিন্তু আমি বাংলা ভাষা ভুলে গেছি। তাই মনের ভাব বাংলায় প্রকাশ করতে পারি নি। দীর্ঘদিন ভিন্ন পরিবেশে বড় হওয়ায় তাঁদের কাছে আমি ছিলাম অচেনা এক মানুষ।

পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ায় থাকলেও বাংলাদেশে তার পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন ওয়াজি। তাঁর বড় ভাই মো. সাদেক ২০১৮ সালে মারা গেছেন। ছোট ভাই মো. ফয়েজউল্লাহ ও মো. ইসমাইল কৃষিজীবী। ছোট বোন জাহানারা বেগম গৃহিণী। তাঁরা সবাই থাকেন মনপুরায়।

এ পর্যন্ত তিনবার ওয়াজি বাংলাদেশে পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁদের জন্য নিয়মিত অর্থও পাঠান। চলতি বছরের শুরুর দিকে তাঁর মা আনোয়ারা বেগম মারা গেছেন। করোনার সংকটে বাংলাদেশে যেতে পারছেন না এবং সেখানে টাকাও পাঠাতে পারছেন না। বাংলাদেশ নিয়ে ভাবেন ওয়াজি, তার পরিবার নিয়ে ভাবেন - ভাবেন বাংলাদেশের গরিব মানুষদের জন্য।
Waji with his family
বাংলাদেশে তোলা পরিবারের সাথে ওয়াজিউল্লাহ Source: ওয়াজিউল্লাহ
ওয়াজি গর্ব করে বলেন, তিনি বাঙালি, এটা তার গর্ব। কখনই ভুলেন নি তার জন্মভূমিকে।

একদিন ওয়াজিউল্লাহ থেকে হয়ে গেলেন ওয়াজি। তিনি বলেন, আমার আগের নামটা উচ্চারণের ক্ষেত্রে এখানকার মানুষদের অসুবিধা হয়। তাই ওয়াজিউল্লাহ থেকে সংক্ষিপ্ত করে ওয়াজি রাখলাম।

ভবিষৎ পরিকল্পনা জানাতে গিয়ে ওয়াজি বাংলাদেশ ও ভারতে ব্যবসা করার কথা জানানেল। সীমান্ত পুনরায় খুললেই তিনি তার যাত্রা শুরু করবেন। দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়াতে থাকলেও এখনো রয়েছে বাংলাদেশের প্রতি তার টান। এখনো ভাবেন বাংলাদেশকে নিয়ে, বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে।

ওয়াজিউল্লাহর সাক্ষাৎকারটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।

Follow SBS Bangla on .

Share
Follow SBS Bangla

Download our apps
SBS Audio
SBS On Demand

Listen to our podcasts
Independent news and stories connecting you to life in Australia and Bangla-speaking Australians.
Ease into the English language and Australian culture. We make learning English convenient, fun and practical.
Get the latest with our exclusive in-language podcasts on your favourite podcast apps.

Watch on SBS
SBS Bangla News

SBS Bangla News

Watch it onDemand